ঈদ মানেই খুশি,
ঈদ
মানেই আনন্দ। আর ঈদ এলেই ব্যতিক্রম ঘটে আমাদের
দৈনন্দিন জীবনে। ভুলে যাই নানা বিধিনিষেধ। যার ফলে প্রায়শই আমাদের স্বাস্থ্যগত নানা ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে
হয়। এর ফলে অনেকের ঈদের আনন্দ নিরানন্দ হয়ে যায়। তবে একটু সচেতনতা ও বিধি নিষেধ মেনে চললে ঈদের আনন্দ হয়ে উঠবে
আরও প্রাণবন্ত।
কোরবানির ঈদের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বসে গেছে গরু-ছাগলের হাট, বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়ে গেছে ঈদের
প্রস্তুতি। তবে ঈদ এবং ঈদ পরবর্তী সময়ে ভালো থাকতে
হলে চাই একটু বাড়তি সচেতনতা। চাই
পরিমিতি জ্ঞান ও সংযম। চাই
নাগরিক সচেতনতা।
আসুন জেনে নিই ঈদের সচেতনতা নিয়ে কিছু তথ্য!
★ ভ্রমণ: প্রতিটি
ঈদে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকা সহ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামের বাড়ী এবং গ্রামের বাড়ী
থেকে শহরে ঈদ করতে আসে। ছেলে-মেয়ে
পরিবার পরিজন নিয়ে আসেন বেশীর ভাগ মানুষ। চড়তে হয়
লঞ্চ-ষ্টিমার, বাস, ট্রেন ইত্যাদিতে। যাদের প্রাইভেট যানবাহন নেই অথবা বিমানে চড়েন না তাদেরতো
বিডম্বনার শেষ নেই। বিশেষ করে যাদের দুরপাল্লার বাসে বাড়ী
ফিরতে হয় তাদের অনেকেই বাসে বমি করে থাকেন। এসব
যাত্রীদের উচিত গন্তব্যে রওনা হবার অন্তত: আধা ঘন্টা আগে বমির জন্য সতর্কতামূলক ওষুধ
যেমন অমিডন ট্যাবলেট অথবা সিরাপ সেবন করা এতে রাস্তায় এই বিব্রতর স্বাস্থ্য সমস্যা
থেকে রেহাই পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে।
★ খাবার
দাবার: ঈদ এলেই বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় নানা ধরনের খাবার। যে গুলোর বেশির ভাগই তেল ও মসলা জাতীয় খাবার। ঈদে অতিরিক্ত খাবার বিশেষ করে আমিষ জাতীয় খাবার খেলে বিভিন্ন
ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। হতে পারে
বদহজম, ডায়রিয়া, পেটব্যথা, বদঢেঁকুরের মতো সমস্যা।
যাদের আলসারের সমস্যা আছে তাদের বুকে জ্বলা বাড়তে পারে। অতিরিক্ত লবণ ও মসলাযুক্ত খাবার খেলে এসিডিটির সমস্যা দেখা
দিতে পারে। এসব থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ভাজাপোড়া
খাবার পরিহার করুন। পরিমিত গোশত খেলে সুস্থ থাকা সম্ভব। অনেকে মনে করেন,
পেট
পুরে গোশত খাওয়ার পর কোমল পানীয় পান করলে বুঝি সব সমস্যার মুক্তি। এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। সমস্যার
মুক্তি তো মিলবেই না, দেখা দিতে
পারে এসিডিটি। সালাদ ও ফলমূল বেশি করে খান, প্রচুর পানি পান করুন।
★ নতুন জামা-কাপড়
পরিধান: ঈদে সবাই কম-বেশি নতুন জামা-কাপড় পরেন। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের বেলায় নতুন জামা-কাপড় ছাড়াতো ঈদ ভাবাই যায়না। প্রতিটি নতুন জামা-কাপড় কিনে ধোলাই করে পরা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে নতুন কাপড়ের রং ও কেমিক্যাল থেকে কন্টাক্ট
এলার্জি হতে পারে। শরীর চাকা চাকা হয়ে ফুলে যেতে পারে। পাশাপাশি যাদের নতুন কাপড়ে এলার্জি হয় তাদের জামা-কাপড় ধুয়ে
পরা উচিত।
★ ত্বকের
যত্ন: ঈদ মানেই বাড়তি সাজগোজ। আর এই
সুযোগে বিভিন্ন চর্মরোগের জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। ঈদে মেহেদী পরা বাঙালী নারীদের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তবে আমাদের দেশে প্যাকেট জাত যেসব মেহেদী পাওয়া যায় সেগুলোর
বেশীর ভাগই নিম্নমানের ও ক্ষতিকর কেমিক্যল যুক্ত। এতে অনেকের মারাত্বক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। মেহেদী লাগানোর স্থান ফুলে যায়, লাল হয়। অনেক সময়
তীব্র চুলকানি হয়।
যাদের এলার্জি আছে তাদের কৃত্রিম মেহেদী না লাগানোই ভালো। তারা
প্রাকৃতিক মেহেদী ব্যবহার করতে পারেন। একই
ভাবে যাদের কসমেটিকে এলার্জি হয় তারাও ভারী মেকআপ পরিহার করতে পারেন।
★ কিছু
স্বাস্থ্য টিপস •••►
১/ ঈদের তিন দিন আগে থেকেই ও ঈদ উত্সব চলা পর্যন্ত প্রচুর পানি
পান করুন বা পানি পান করা বাড়িয়ে দিন। গুরুপাক
খাবার খেলে প্রচুর পানি পান করুন। কারণ পানি
খাবার হজমে সহায়তা করার পাশাপাশি আপনাকে সতেজও রাখে। তাই যেখানেই যান না কেন, একটু কষ্ট করে আপনার সাথে পানি রাখুন। বারে বারে পানি পান করুন।
২/ লাল গোশত শরীরের জন্য ক্ষতিকারক এ কথা আজ সবাই জানে। লাল গোশত বা রেড মিট, অর্থাৎ গরু বা ছাগলের গোশতে আছে প্রচুর স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা
সম্পৃক্ত চর্বি, যা
স্থূলতা বাড়ায়, রক্তনালিতে
চর্বি জমায়, হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহকে ব্যাহত করে, রক্তচাপ
বাড়ায়, ডায়াবেটিস জটিল করে তোলে,
স্ট্রোক
ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া
বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার যেমন কোলন ও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে
এ লাল গোশত। তাই ঈদে তো লাল গোশতের নানা পদের সমাহার হবেই, তবে
অপরিমিত অবশ্যই খাবেন না। বিশেষ করে
যারা স্থূলতা, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বা হৃদরাগে ভুগছেন, তারা বিশেষ ভাবে সাবধান থাকবেন। মনে রাখবেন,
কোনো
অবস্থায়ই দৈনিক
খাদ্য তালিকায় চর্বি জাতীয় খাদ্য যেন ৩০ শতাংশের বেশি না হয়। আর এর মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকবে মাত্র ৭ শতাংশ।
৩/ যে চর্বি ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় শক্ত বা জমাট থাকে, সেটিই স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা সম্পৃক্ত চর্বি। লাল গোশত ছাড়াও ঘি, মাখন, মার্জারিন, ক্রিম প্রভৃতিতে আছে এ সম্পৃক্ত চর্বি। তাই রান্নার সময় খেয়াল করুন কয়েকটি জিনিস গোশতের গায়ে যে সাদা জমাট চর্বি লেগে থাকে, তার পুরোটাই ছেঁটে ফেলে দিন। রান্নায় ঘি,
মাখন
বা ডালডার ব্যবহার একে দ্বিগুণ ক্ষতিকর করে তুলবে। রান্নায় তেল যথাসম্ভব কম ব্যবহার করুন।
৪/ রান্নার পদ্ধতি গুলো পরিবর্তন করেও মাঝে-মধ্যে ক্ষতি এড়ানো যায়। উদাহরণ: গোশতের নানা কাবাব, ভাজা বা ডিপ ফ্রাই না করে গ্রিল, সেদ্ধ বা খুবই সামান্য তেলে স্টু করা গোশত দেহের জন্য কম ক্ষতি বয়ে আনে। সবজি বা সালাদের সঙ্গে সেদ্ধ করা গোশত, নুডলস বা ম্যাকারনির মধ্যে সেদ্ধ গোশত
দিয়েও নানা পদ তৈরি করা যায়।
৫/ ট্রান্স ফ্যাট হচ্ছে আরেক ক্ষতিকর চর্বি, যা রক্তের এলডিএল বাড়ায় এবং ভালো চর্বি
এইচডিএলকে কমিয়ে দেয়। বেকারি ও
রেস্তোরাঁয় ভেজিটেবল ফ্যাট জমাট করার মাধ্যমে ট্রান্স ফ্যাট উৎপন্ন হয়। দোকানের বেক করা খাবার ও ফাস্টফুডে রয়েছে এ ট্রান্স ফ্যাট। তাই ঈদের খাবারে নানরুটি, কেক, পরোটা, ফ্রাই করা খাবার, বার্গার, সসেজ, পিৎজা ও এ
জাতীয় ফাস্টফুড পরিহার করাই ভালো।
৬/ কোরবানির ঈদ বলেই সবজি বা মাছকে বিদায় জানাতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিশেষ করে, আঁশ বা ফাইবার এ সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখতে পারে। আঁশ জাতীয় খাবার চর্বি হজমে বাধা দেয়
এবং কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। বাজারে
উঠতে শুরু করেছে শীতের সবজি। প্রতিদিনের
খাদ্য তালিকায় অবশ্যই এ সবজি অন্তর্ভুক্ত করুন। খাবার টেবিলে থাকুক প্রচুর পরিমাণে সালাদ বা কাঁচা সবজি। ফ্রিজের মাছগুলো একেবারে অবহেলা করবেন না।
৭/ নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটার উপকারিতা ভুলে যাবেন না এ ডামাডোলে। যে বাড়তি
ক্যালরি এ সময়ে গ্রহণ করছেন,
তা
পোড়াতে প্রচুর হাঁটুন। হেঁটেই না
হয় আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়ি দেখা করতে যান। সিঁড়ি ভাঙুন,
ঘরের
কাজে সাহায্য করুন, পরিশ্রম
করুন। বাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার করতে নিজেই নেমে
পড়ুন। এতে উপকারই হবে বেশি।
৮/ বেশির ভাগ লোকের, বিশেষ করে বয়স্কদের এ সময় গ্যাস্ট্রিক, আলসারের ব্যথা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বেড়ে যায়। কারণ সেই পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস। এ সমস্যা এড়াতে কম তেল, কম মশলা ও কম গোশত খাওয়ার অভ্যাস করুন। প্রয়োজনে
গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ চেয়ে নিন চিকিৎসকের কাছ থেকে। কোষ্ঠ পরিষ্কারের জন্য প্রতিদিন প্রচুর আঁশযুক্ত খাবার খান।
৯/ গেঁটে বাত বা ইউরিক এসিড বেশি যাদের এবং যাদের কিডনিতে সমস্যা আছে, তাদের জন্যও গোশতের আমিষ ক্ষতিকর। তারা অবশ্যই চিকিৎসক কর্তৃক বরাদ্দকৃত আমিষের চেয়ে বেশি পরিমাণে আমিষ খাবেন না। তাতে বিপদ হতে পারে।
১০/ কোরবানির পর স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গোশত সংরক্ষণ করুন। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি এবং এর আশপাশ পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করে
ফেলুন। রাস্তার ওপর এবং যত্রতত্র কোরবানি দিয়ে রক্ত ও আবর্জনা ফেলে রাখবেন না। নির্দিষ্ট স্থানে গর্ত করে আবর্জনা ও রক্ত ফেলা নিশ্চিত করুন। জীবাণুনাশক পাউডার, ডেটল ও গরম পানি ব্যবহার করুন। নিজের ও প্রতিবেশীর স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বজায় রাখতে সচেতন
হতে হবে সবাইকে।
নিজে সচেতন হোন,
অন্যকেও
সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব পালন করতে সাহায্য করুন। সবার জন্য ঈদ মঙ্গল ও খুশির বার্তা বয়ে আনুক।
[আপনাদের সুখী জীবনই
আমাদের কাম্য। ধন্যবাদ।]
0 comments:
Post a Comment