যুক্তিহীন
ভ্রান্ত ধারণা বা গোঁড়ামির অপর নাম কুসংস্কার। বাংলার
আনাচে কানাচে এখনো প্রচলিত আছে অনেক কুসংস্কার যার কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
যুগের পর যুগ। শুধু পশ্চাৎপদ জনতা নয় দেশের
সর্বস্তরেই এ কুসংস্কার আসন গেড়ে আছে। স্বাস্থ্য
বিষয়ক এমন কিছু ভ্রান্ত ধারণা এবং সেগুলোর প্রকৃত কারণ আজকে আমরা আলোচনা করবো।
জোড়া
ডিম বা কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয়ঃ
যমজ
বাচ্চা হয় যখন কোন নারীর একই সময় দুটি ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। জোড়া ডিম বা জোড়া কলা প্রকৃতির নিয়মেই হয়ে থাকে, এদের মাঝে
এমন কোন উপাদান থাকে না যা যমজ বাচ্চা হতে সাহায্য করবে। একটা
সাধারণ কলা বা একটা সাধারণ ডিমে যা থাকে জোড়া কলা বা ডিমে তাই থাকে, শুধু একটার
স্থানে দুটো একসাথে থাকে। তাই জোড়া
ডিম বা কলাতে যমজ বাচা হয় না।
আনারস
আর দুধ এক সাথে খাওয়া যায় নাঃ
এখন
পর্যন্ত আনারস এবং দুধের মাঝে এমন কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া খুঁজে পাওয়া যায়নি
যার ফলে এদেরকে এক সাথে খেলে সেটা মানুষের জীবনহানি করবে। বর্তমানে
অনেক খাবারেই দুধ ও আনারস একসাথে মেশানো হয় এবং সারা বিশ্বেই তা খাওয়া হয়। কাস্টার্ড নামক ডেজার্টে দুধের সাথে নানারকম ফল মেশানো হয় যার
মাঝে আনারসও থাকে। কাস্টার্ড খেয়ে বিষক্রিয়ায় কেউ মারা
গেছে বলে জানা যায় না।
চিনি
বা মিষ্টি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়ঃ
যারা
ডায়াবেটিস রোগী তারা মিষ্টি বেশি খেলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায় যা কমানো তাদের
দেহের পক্ষে সহজসাধ্য হয় না কিন্তু যারা ডায়াবেটিক নন তাদের দেহ রক্তের অতিরিক্ত
গ্লুকোজ ব্যবহার করে ফেলতে পারে, তাই তারা মিষ্টি বেশি খেলেও কোন সমস্যা
নেই। শুধুমাত্র যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
হবার সম্ভাবনা আছে এমন ব্যক্তিদেরকে ডাক্তাররা মিষ্টি বা চিনি কম করে খেতে বলেন।
চিনি
খেলে কৃমি হয়ঃ
কৃমি
আমাদের দেহে বসবাসকারী পরজীবী যা সাধারণত অন্ত্র বা খাদ্যনালীতেই বাস করে। আমাদের শরীর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করে তারা বেঁচে থাকে। কৃমি আমাদের দেহে প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর ভাবে রান্না ও
পরিবেশিত খাবার খেলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে। অপরিষ্কার
খাবার, দূষিত
পানি, ময়লা
হাঁতে খাবার খেলে, খালি পায়ে মাটিতে হাঁটলে, মল ত্যাগের পরে হাত জীবাণুমুক্ত
না করলে ইত্যাদি কারণে কৃমি আক্রান্ত করতে পারে আমাদেরকে। অতিরিক্ত
চিনি খেলে কৃমির বংশবৃদ্ধির কোন উপকার হয় না। এর
সাথে চিনি বেশি খাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই।
লবণ
ভেজে খেলে প্রেসার বাড়ে নাঃ
আমাদের
উচ্চ-রক্তচাপের রোগীদের মাঝে এই ধারণাটি প্রচলিত আছে যে খাবারের সময় পাতে লবণ
খেতে হলে তা ভেজে খেতে হবে, তাহলে নাকি রক্তচাপ বাড়বে না। অতিরিক্ত
লবণ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। লবণের
রাসায়নিক পরিবর্তন না হলে লবণ লবণই থাকবে, সেটা ভেজে বা না ভেজে যেভাবেই খাওয়া
হোক না কেন সেই লবণই থাকবে কারণ লবণের রাসায়নিক পরিবর্তন করার কোন সামর্থ্য এতো
অল্প তাপমাত্রায় সম্ভব না। ডাক্তাররা
উপদেশ হিসেবে বলেন কাঁচা লবণ খাবেন না। কাঁচা লবণ
বলতে বোঝানো হয় পাতে লবণ খাওয়া। কাঁচা লবণকে
ভেজে পাকিয়ে ফেলে আসলে কোন লাভই হবে না।
গরমে
কৃমির ওষুধ খাওয়া যায় নাঃ
টক
খেলে কাটা সারে নাঃ
কোথাও
কেটে গেলে এদেশে অনেকে টক খেতে মানা করেন, বলেন টক খেলে নাকি কাটা সারতে দেরি হয়। একথাটি সম্পূর্ণরূপেই ভুল। প্রকৃতপক্ষে
টক খেলে কাঁটা আরো দ্রুত সারে। সাধারণত টক
ফল যেমন লেবু, কামরাঙ্গা, কাঁচা আম ইত্যাদি টক ফলে থাকে প্রচুর
পরিমাণে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি কাটা বা ক্ষতস্থানের আঘাত
সারাতে প্রয়োজনীয় কোলাজেন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই কেটে গেলে টক কম না খেয়ে বেশি করে খেতে হবে দ্রুত
ক্ষতস্থান পূরণের জন্য।
গর্ভকালীন
অবস্থা নিয়ে এখনও বেশ কিছু কুসংস্কার রয়েছে, যেমনঃ
গর্ভবতী অবস্থায় বেশি খাবার গ্রহণঃ
অনেক
মায়ের মধ্যে ধারণা গর্ভবতী অবস্থায় বেশি খাবার গ্রহণ করলে বাচ্চা মায়ের গর্ভে
বড় হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসব হয় না,
সিজার
করতে হয়। মা যতোই খাবার খান না কেন একজন সুস্থ
বাচ্চা কখনো খুব বড় হবে না, স্রষ্টার নিয়মেই তার বৃদ্ধি এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে যে সে
মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে না, যেসব মায়েদের ডায়াবেটিস থাকে বা
প্রসবকালীন সময়ে ডায়াবেটিস হয় তাদের বাচ্চার আকার বড় হতে পারে তবে সবসময় না। এ কারণে বেশি খেলে বাচ্চা বড় হবে এটা ভুল ধারণা। অনেকে কম খেয়ে থাকেন বাচ্চা ছোট হবার জন্য যা খুব খারাপ আচরণ। কম খেলে বাচ্চা বাড়বে না, অপুষ্ট শিশু জন্ম নেবে এবং প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী নানা
সমস্যায় পড়বে মা ও শিশু।
নারিকেল
গ্রহণ করলে বাচ্চা অন্ধ হয়ঃ
অর্থহীন
একটি ধারণা, নারকেল
উপাদেয় একটি ফল। নারকেল এ এমন কিছু নেই যা মানব চোখকে
অন্ধ করে দেয়।
হিন্দু
মায়েরা এ সময় মাছ-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেনঃ
মাছ
মাংস না খেলে বাচ্চা বাড়বে না, মা ও পুস্তিহীনতায় ভুগবে। অসুস্থ মা
জন্ম দিবে অসুস্থ এক শিশু। তাই এ সময়
মা ও বাচ্চার শরীর গঠনে মাছ মাংস খাওয়া দরকার।
এধরণের
আরো অনেক কুসংস্কার রয়েছে আমাদের সমাজে। দায়িত্বশীলতার
সঙ্গে নিজেদেরকে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের এসব ভুল ধারণার মূলোৎপাটন করতে, তবেই আমরা
পাবো সুস্থ্য একটি জাতি।
[আপনাদের
সুখী জীবন আমাদের কাম্য। ধন্যবাদ।]
0 comments:
Post a Comment