আজ সাধারণ ভাবে পরিচিত দাঁতের পোকা নিয়ে আলোচনা করব। তবে আলোচনার শুরুতেই বলে দিতে চাই দাঁতে পোকা হয় না; হয় দন্তক্ষয়।
দাঁতের যে রোগটি নিয়ে জনমনে সবচেয়ে ভুল ধারণা আসন গেড়ে বসেছে তার নাম হলো দাঁতের ক্ষয় রোগ। চিকিৎসকরা একে ডেন্টাল ক্যারিজ বলে থাকেন কিন্তু অনেকেই একে দাঁতের পোকা হিসেবে অভিহিত করেন। অথচ দাঁতে কোনো পোকা হয় না বরং এসিডের কারণে ডেন্টাল ক্যারিজ মানে দাঁতের ক্ষয়রোগ ঘটে থাকে।
দন্তক্ষয়ের ফলে দাঁতে যে ধরনের ক্ষুদ্র গর্তের সৃষ্টি হয় সেখান থেকে পোকা বের করে দেখানো হয় অথচ কথিত এই পোকার দাতের ওই ক্ষুদ্র গর্তে মোটেও জায়গা হওয়ার কথা নয়। অথচ অনেকেই এই অতি ক্ষুদ্র গর্ত থেকেই এক বা একাধিক পোকা বের করে দেখান। আমাদের গা গরম থাকে। গরম থাকে আমাদের মুখগহববরও। কাজেই আমাদের মুখের মধ্যে যে স্বাভাবিক তাপ থাকে অথবা আমরা যখন গরম কোনো খাবার দাবার বা চা, দুধ ইত্যাদি পান করি সে অবস্হায় ওই ধরনের পোকা বেঁচে থাকতে পারবে না। আলোচনার শুরুতেই তাই স্পষ্ট ভাষায় আমরা বলে দিতে চাই, জীবিত মানুষের দাঁতে কখনো কোনো অবস্থায়ই পোকা হয় না। দাঁতে যা হয় তার নাম দন্তক্ষয় বা ডেন্টাল ক্যারিজ।
অতি ধীরে ধীরে অব্যাহত গতিতে এই রোগের বিকাশ হয়। কেনো এই রোগ দেখা দেয়? মুখে জমে থাকা খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার মুখগহ্বরের বিভিন্ন রোগজীবাণু ভেংগে ফেলে যাকে বিপাক ক্রিয়া বলা হয়। আর এই ক্রিয়ার উপজাত হিসেবে ল্যাকটিক এসিড, এসিটিক এসিড, পাইরোভিক এসিড সহ নানা ধরনের এসিড তৈরি হয়। এ সব ফলে আমাদের মুখের ভেতরে এসিডের আক্রমণ ঘটে। এসিডের এই আক্রমণের ফলে দাঁত থেকে ক্যালসিয়াম, ফসফরাসের মত গুরুত্বপুর্ণ খনিজসমুহ দাঁতের উপরিভাগের অংশ এনামেল থেকে বের হয়ে যায়। আর এভাবেই দাঁতের ক্ষয়রোগ দেখা দেয়।
দন্তক্ষয় দাঁতের বিভিন্ন জটিলতার প্রারম্ভিক অবস্থা।
নিচের চার্ট থেকে দন্তক্ষয়ের ধারাবাহিক পরিনাম বোঝা যেতে পারেঃ
প্রাথমিক অবস্থা → মাধ্যমিক অবস্থা → চূড়ান্ত অবস্থা
দন্তক্ষয়(Caries) দন্তমজ্জা প্রদাহ(Pulpitis) পরিদন্ত প্রদাহ(Periodontitis)
↓
জটিলতা সমুহ
(Periapical Cyst,
Osteomyeliti,
Cellulitis)
প্রাথমিক অবস্থাঃ জীবানু আক্রমনের ফলে দাঁতের গায়ে সৃষ্টি হয় অতি ক্ষুদ্র গর্ত যা শুরুতে দাঁতের উপর একটি কালো দাগ বা ফোটার মত দেখা যায়; যা ক্রমান্বয়ে বড় হতে থাকে। এবং এই গর্ত দাঁতের গভীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং বিভিন্ন উপসর্গ তৈরী করে। প্রাথমিক অবস্থায় Thermal sensitivity বা ঠান্ডা বা গরম পানিতে “শিরশির করা” উপসর্গ তৈরী হয়।
মাধ্যমিক অবস্থাঃ প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ না করলে Caries ধীরে ধীরে আরো গভীর হয়ে দাঁতের মজ্জায়(Pulp) পৌঁছে যেতে পারে। জীবানুর আক্রমন দাঁতের মজ্জার নরম টিস্যুতে প্রদাহ (Inflamation) তৈরী করে এবং এর ফলে সৃষ্টি হয় অসহনীয় তীব্র ব্যাথা। দাঁতের এই অবস্থাকে বলা হয় Pulpitis বা দন্তমজ্জার প্রদাহ। দাঁত থেকে সৃষ্ট এই ব্যাথা চোয়াল, কান, চোখ বা মাথায় ছড়িয়ে পড়তে বা অনুভূত হতে পারে। এই অবস্থায় শুধু Antibiotic বা ব্যাথার ঔষধে তেমন কোন উপকার হয় না। এই প্রদাহ (Pulpitis) এর ফলে কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের ভেতরই দাঁতের মজ্জার রক্তনালী নষ্ট হয়ে যায় এবং মজ্জার স্নায়ুতন্তু (Nerve fiber) ও আন্যান্ন কোষ-কলাও নষ্ট হয়ে যায় বা পঁচে যায়। স্নায়ু-তন্তু নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ দাঁতের ব্যাথা চলে যায়। এ অবস্থায় রোগ ভালো হয়ে গেছে বলে রোগী মনে করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে দাঁতটি মরে (Non vital) যায়।
চূড়ান্ত অবস্থাঃ সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা করা না হলে মরে যাওয়া (Non vital) দাঁতের পঁচা মজ্জা (Necrosed Pulp) থেকে নির্গত রস ও জীবানু ক্রমে দাঁতের শিকড়ের অগ্রভাগের সুস্থ্য টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে। শিকড়ের অগ্রভাগের টিস্যুতে জীবানুর আক্রমনে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় দাঁত খুবই স্পর্শকাতর থাকে। ফলে কামড় দিলেই ব্যাথা হতে পারে। ব্যাথার তীব্রতা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়। তীব্র প্রদাহের ফলে সেখানে পূঁজ (Peri Apical Abscess) তৈরী হয়। এই পুঁজ দাঁতের ক্ষয়প্রাপ্ত পথে বেড়িয়ে আসতে পারে। তবে এই পথ কোন ভাবে বন্ধ হয়ে গেলে এবং পুঁজ বেড়িয়ে আসতে না পারলে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।
আমরা জানি, রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। কাজেই যে কারণে দাঁতের ক্যারিজ বা দন্তক্ষয় রোগ হয়, সে কারণগুলো দূর করতে পারলে এ রোগের হাত থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যায়।
প্রতিরোধের
উপায়ঃ
১/ প্রতিবার খাওয়ার পর দাঁত ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে, বিশেষ করে, রাতে ঘুমানোর আগে টুথ ব্রাশ, পেস্ট ও নাইলনের সুতা দিয়ে দাঁত এবং দাঁতে লেগে থাকা খাদ্য কণা পরিষ্কার করতে হবে।
২/ দাঁত পরিষ্কারের অর্থ শুধু দাঁত পরিষ্কারই বোঝায় না, দাঁত, মাড়ি ও জিহ্বা, দুই দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকা খাবারসহ মুখের সর্বত্র লেগে থাকা আঠালো জীবাণুর প্রলেপ দূর করা বোঝায়।
৩/ খাওয়ার পর কেবল কুলকুচি করলে জীবাণু দূর হয় না। যেভাবে যা দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করুন না কেন, দাঁত এবং দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকা খাবার যাতে ভালোভাবে পরিষ্কার হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৪/ ঘন ঘন চিনি-জাতীয় খাদ্য যেমনঃ- চকলেট, বিস্কুট, আইসক্রিম ইত্যাদি মিষ্টি-জাতীয় খাবার কম খাওয়া কিংবা খাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে মুখ পরিষ্কার করা জরুরি।
৫/ রাতে ঘুমের মধ্যে শিশুদের বোতলের দুধ কোনোভাবেই খাওয়ানো উচিত নয়। কোনো বিশেষ কারণে যদি খওয়াতেই হয়, তবে সে ক্ষেত্রে শিশুর দাঁত সঙ্গে সঙ্গে ভেজা পাতলা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
৬/ ছয় মাস পর পর অভিজ্ঞ দন্ত চিকিৎসকের উপদেশ ও পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৭/ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দাঁতের ক্যারিজের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। যেমন—খাবার পানিতে পরিমাণমতো ফ্লুরাইডযুক্ত করা, দাঁতের গায়ে ফ্লুরাইডের দ্রবণ বা জেল লাগিয়ে দেওয়া, ফ্লুরাইডের দ্রবণ দিয়ে কুলি করা, ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করা, দাঁতের নাজুক স্থানে আগাম ফ্লুরাইডযুক্ত ফিলিং করিয়ে নেওয়া ইত্যাদি।
৮/ ব্যথার কারণে দাঁত ফিলিং করা সম্ভব না হলে কিংবা ফিলিং করার পর ব্যথা শুরু হলে অথবা দাঁতের শাঁস নষ্ট হয়ে মাড়ি ও চোয়াল ফুলে গেলেও বর্তমানে দাঁতটিকে না তুলে বিশেষ এক আধুনিক চিকিৎসা রুট ক্যানেলের মাধ্যমে দাঁতটি অপারেশন করে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
আশার কথা হচ্ছে, অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের মতো দাঁতের ক্যারিজ প্রতিরোধের টিকা পরীক্ষাধীন আছে, যা ব্যবহারে রোগীরা অতি সহজেই দন্তক্ষয় বা ক্যারিজের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।
আপনাদের সুখী জীবনই আমাদের কাম্য । ধন্যবাদ।
0 comments:
Post a Comment